ড. মুহাম্মদ ইউনুস: দারিদ্র্য বিমোচনের অনন্য পথিকৃৎ
ড. মুহাম্মদ ইউনুস একজন বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ, ব্যাংকার এবং সামাজিক উদ্যোগপতি, যিনি ক্ষুদ্রঋণ এবং সামাজিক ব্যবসার ধারণাকে বিশ্বব্যাপী প্রসারিত করে দারিদ্র্য বিমোচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। ১৯৪০ সালের ২৮ জুন চট্টগ্রামের একটি মধ্যবিত্ত পরিবারে তার জন্ম হয়। তার বাবা ছিলেন একজন স্বর্ণকার এবং মা ছিলেন গৃহিণী। ছোটবেলা থেকেই ড. ইউনুসের মধ্যে ছিলো অন্যের জন্য কিছু করার অদম্য ইচ্ছা।
প্রাথমিক শিক্ষা এবং ক্যারিয়ার
ড. ইউনুস তার শিক্ষাজীবন শুরু করেন চট্টগ্রামের লামাবাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এরপর চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল থেকে মাধ্যমিক এবং চট্টগ্রাম কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। তার অসামান্য মেধার কারণে তিনি ফুলব্রাইট স্কলারশিপ পেয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ভ্যান্ডারবিল্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করতে যান। সেখানে তিনি উন্নয়ন অর্থনীতি নিয়ে গবেষণা করেন এবং ১৯৬৯ সালে তার পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা এবং বাস্তব অভিজ্ঞতা
যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরে এসে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের সময়, তিনি বাংলাদেশের দারিদ্র্যের প্রকৃত অবস্থা কাছ থেকে দেখার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছাকাছি একটি গ্রামে যান। সেখানেই তিনি দেখেন যে, মাত্র ২৭ ডলার ঋণের অভাবে ৪২টি পরিবারের জীবন বিপন্ন। সেই মুহূর্তে তার মনে আসে, সামান্য পরিমাণ অর্থ সাহায্যও দরিদ্র মানুষের জীবন বদলে দিতে পারে। এই ধারণাই পরে ক্ষুদ্রঋণের ভিত্তি হয়ে ওঠে।
গ্রামীণ ব্যাংকের জন্ম এবং ক্ষুদ্রঋণের সাফল্য
ড. ইউনুস প্রথমে নিজ অর্থায়নে গ্রামের মানুষের মাঝে ক্ষুদ্রঋণ বিতরণ শুরু করেন। তার এই উদ্যোগ সফল হওয়ার পর, তিনি ১৯৭৬ সালে গ্রামীণ ব্যাংকের ভিত্তি স্থাপন করেন, যা ১৯৮৩ সালে একটি স্বাধীন ব্যাংক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। গ্রামীণ ব্যাংকের মডেল অনুসরণ করে বিশ্বের বহু দেশে ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি চালু করা হয়েছে। এই ব্যাংক দরিদ্র মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য একটি শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছে এবং দারিদ্র্য বিমোচনে অপরিসীম অবদান রেখেছে।
নারীর ক্ষমতায়ন
গ্রামীণ ব্যাংকের মূল লক্ষ্য ছিলো দরিদ্র নারীদের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন। ড. ইউনুস বিশ্বাস করতেন যে, নারীরা সমাজে উন্নয়ন আনতে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে। গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণগ্রহীতাদের ৯৭% ছিলেন নারী, যারা এই ঋণ নিয়ে নিজেদের জীবনে অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা অর্জন করতে পেরেছেন। এই মডেলটি শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়নেই নয়, সামাজিকভাবে নারীদের ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রেও একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এনেছে।
নোবেল শান্তি পুরস্কার এবং বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি
২০০৬ সালে ড. মুহাম্মদ ইউনুস এবং তার প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংক যৌথভাবে নোবেল শান্তি পুরস্কার লাভ করেন। দারিদ্র্য বিমোচনে তাদের অবদান বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি পায়। নোবেল কমিটি উল্লেখ করে যে, “ড. ইউনুস এবং গ্রামীণ ব্যাংক সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য নিচ থেকে উপরের দিকে একটি শক্তিশালী আন্দোলনের সূচনা করেছে।”
সামাজিক ব্যবসা: নতুন এক ধারণা
ড. ইউনুস তার ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমের পাশাপাশি সামাজিক ব্যবসার ধারণা প্রবর্তন করেন। তার মতে, সামাজিক ব্যবসার মূল উদ্দেশ্য হলো লাভ অর্জন নয়, বরং সমাজের কোনো সমস্যা সমাধান করা। তিনি একে "বিজনেস প্লাস" হিসেবে অভিহিত করেন, যেখানে উদ্যোক্তারা নিজেদের উদ্যোগের মাধ্যমে সামাজিক সমস্যাগুলো সমাধান করে। তার এই ধারণা সারা বিশ্বে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে সফলভাবে প্রয়োগ করা হয়েছে।
বিভিন্ন উদ্যোগ এবং প্রভাব
ড. ইউনুসের উদ্যোগ কেবল ক্ষুদ্রঋণ বা সামাজিক ব্যবসার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। তিনি গ্রামীণ টেলিকম, গ্রামীণ শক্তি, গ্রামীণ কল্যাণসহ নানা ধরনের উদ্যোগে জড়িত ছিলেন, যেগুলো বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এছাড়া তিনি শিক্ষাক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন, বিশেষ করে দারিদ্র্যপীড়িত এলাকার শিশুদের শিক্ষার জন্য নানা প্রকল্প হাতে নিয়েছেন।
বিভিন্ন সম্মাননা ও পুরস্কার
ড. মুহাম্মদ ইউনুস তার জীবনের বিভিন্ন সময়ে অসংখ্য পুরস্কার এবং সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম (যুক্তরাষ্ট্র), কংগ্রেশনাল গোল্ড মেডেল (যুক্তরাষ্ট্র), সিমন বলিভার পুরস্কার (ইউনেস্কো) এবং অসংখ্য সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি।
ড. ইউনুসের প্রভাব ও উত্তরাধিকার
ড. মুহাম্মদ ইউনুসের কাজ শুধুমাত্র একটি ব্যাংকের প্রতিষ্ঠার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। তিনি দারিদ্র্য বিমোচনের ধারণাকে একটি আন্দোলনে পরিণত করেছেন, যা সারা বিশ্বে লাখো মানুষের জীবন বদলে দিয়েছে। তার মডেল বিভিন্ন দেশে সফলভাবে প্রয়োগ করা হয়েছে এবং বহু মানুষকে দারিদ্র্যের অভিশাপ থেকে মুক্তি দিয়েছে। তিনি একটি সমাজের পরিবর্তন করতে যে নেতৃত্ব ও উদ্ভাবনশক্তি প্রয়োজন, তার জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই তা দেখিয়েছেন।
ড. মুহাম্মদ ইউনুস এমন একজন মানুষ, যিনি নিজের চিন্তাশক্তি এবং কর্মের মাধ্যমে বিশ্বের দারিদ্র্যপীড়িত মানুষের জন্য নতুন পথ দেখিয়েছেন। তার জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপ থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে। ড. ইউনুস আমাদের শিখিয়েছেন, কিভাবে সংকল্প, উদ্ভাবন এবং নেতৃত্বের মাধ্যমে দারিদ্র্য, বৈষম্য এবং সামাজিক অবিচারের বিরুদ্ধে লড়াই করা যায় এবং সত্যিকার অর্থেই একটি পরিবর্তন আনা যায়। তার জীবন ও কাজ আমাদের জন্য একটি আলোকবর্তিকা হিসেবে কাজ করবে।
Comments
Post a Comment
MIDS24-এর সাথে আপনার প্রযুক্তিগত সম্ভাবনাকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছান। MIDS24 এর সাথেই থাকুন । ধন্যবাদ!